
মার্চ মাসে সারাদেশে ৫৮৭টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৪ জন নিহত এবং ১২৩১ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৮৯ নারী এবং ৯৭ শিশু রয়েছে।
শনিবার (১২ এপ্রিল) সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। মার্চে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৫৮৭টি; এর মধ্যে নিহত ৬০৪ জন এবং আহত কমপক্ষে ১২৩১ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৮৯ জন ও শিশু ৯৭টি। ২৪২টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২৩৩ জন, যা মোট নিহতের ৩৮.৫৭ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪১.২২ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় ১০৯ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ১৮.০৪ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৯৮ জন, অর্থাৎ ১৬.২২ শতাংশ। এই সময়ে ৬টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত, ১৪ জন আহত হয়েছেন। ১৬টি রেল ট্র্যাক দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং ৪ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২৩৩ জন (৩৮.৫৭ শতাংশ), বাসের যাত্রী ৩২ জন (৫.২৯ শতাংশ), ট্রাক-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-ড্রাম ট্রাক-কার্গো ট্রাক আরোহী ৫৬ জন (৯.২৭ শতাংশ), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস- অ্যাম্বুলেন্স-জীপ আরোহী ১৭ জন (২.৮১ শতাংশ), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান) ১১৯ জন (১৯.৭০ শতাংশ), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-টমটম) ২৭ জন (৪.৪৭ শতাংশ) এবং বাইসাইকেল-রিকশা আরোহী ১১ জন (১.৮২ শতাংশ) নিহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২২৮টি (৩৮.৮৪ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ২৫৬টি (৪৩.৬১ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৭২টি (১২.২৬ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে এবং ৩১টি (৫.২৮ শতাংশ) শহরের সড়কে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনাগুলোর ১৫৩টি (২৬.০৬ শতাংশ) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৫৮টি (৪৩.৯৫ শতাংশ) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১১৩টি (১৯.২৫ শতাংশ) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৪৭টি (৮ শতাংশ) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৬টি (২.৭২ শতাংশ) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৩.৯১ শতাংশ, সকালে ২৬.২৩ শতাংশ, দুপুরে ১৯.৭৬ শতাংশ, বিকালে ২৩.৩৩ শতাংশ, সন্ধ্যায় ৬.১৩ শতাংশ এবং রাতে ২০.৬১ শতাংশ।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ৩১ শতাংশ, প্রাণহানি ৩০.৪৬ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৭.৩৭ শতাংশ, প্রাণহানি ১৭.৭১ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.৫০ শতাংশ, প্রাণহানি ১৪.৯০ শতাংশ, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ৮.৮৫ শতাংশ, প্রাণহানি ৮.৯৪ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.১৫ শতাংশ, প্রাণহানি ৭.১১ শতাংশ, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৪.০৮ শতাংশ, প্রাণহানি ৪.৯৬ শতাংশ, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ১০.৩৯ শতাংশ, প্রাণহানি ৯.৪৩ শতাংশ এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৬২ শতাংশ, প্রাণহানি ৬.৪৫ শতাংশ ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৮২টি দুর্ঘটনায় ১৮৪ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম ২৪টি দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে বগুড়া জেলায় ২৭টি দুর্ঘটনায় ৩২ জন নিহত হয়েছে। সবচেয়ে কম নেত্রকোণা জেলায়। এই জেলায় কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি ঘটেনি। আর রাজধানী ঢাকায় ২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং ৫৩ জন আহত হয়েছে।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ সম্পর্কে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল ও তরুণ ও যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানোয় ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। এছাড়া, দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি ও গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজির কারণেও।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ১০ দফা সুপারিশও করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এগুলো হলো- দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে, চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে, বিআরটিএর সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক এবং যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা রাস্তা (সার্ভিস লেন) তৈরি করতে হবে, পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে, গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে, রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে, টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে, ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
গত ফেব্রুয়ারি মাসে ৫৯৬টি দুর্ঘটনায় ৫৭৮ জন নিহত হয়েছিলেন। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিলেন ২০.৬৪জন। মার্চ মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ১৯.৪৮ জন। এই হিসেবে প্রাণহানি কমেছে ৫.৬২ শতাংশ। তবে প্রাণহানি কমার এই সূচক সড়ক নিরাপত্তার কোনো টেকসই উন্নতি নির্দেশ করছে না। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি এবং চালকদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দরকার। যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। এজন্য সরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনমুখী সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে, নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার যানবাহনের অধিকাংশ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা সবসময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন এবং বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালান। ফলে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। তাই, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে পরিবহন শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা এবং সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
নয়াশতাব্দী/এমআর