
পূর্বের মতো নয়, এখন বাংলাদেশের মানুষ শুধু পাহাড় বা কক্সবাজার নয়, খুঁজছে নতুন নতুন পর্যটন গন্তব্য, যেখানে রয়েছে প্রকৃতির নির্মল ছোঁয়া, স্নিগ্ধতা আর নির্জনতা। এমনই এক অনাবিষ্কৃত রত্ন হলো বরগুনা জেলার তালতলীর নিদ্রা সৈকত—যা কেবল একটি সমুদ্র সৈকত নয়, বরং প্রকৃতি, নদী, বন ও মানুষের সাহচর্যে গড়া এক জাদুকরী স্থান।
অবস্থান ও ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য তালতলী উপজেলার সোনাকাটা ইউনিয়নে অবস্থিত নিদ্রা সৈকত স্থানীয়দের কাছে পরিচিত “নিদ্রার চর” নামে, অনেকে বলেন “ডিসির চর”। বঙ্গোপসাগরের উত্তাল ঢেউ আর পেছনে বিষখালী নদী—এই দ্বিমুখী জলরাশি ঘেরা চরটিতে রয়েছে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তর, কেওড়াবন, ঝাউবন ও শ্বাসমূলের বেষ্টনী। এখানেই জোয়ার-ভাটার খেলা, নীলাকাশে চিলের ওড়াউড়ি আর পাখির ডাক মিলিয়ে এক অসাধারণ জীববৈচিত্র্য বিরাজমান।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জীবন্ত আলেখ্য সৈকতের প্রতিটি কণিকা যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নিঃশব্দ কাব্য। বিস্তীর্ণ সমুদ্রতটজুড়ে কোমল বালির রেখা, কেওড়াগাছের গুঁড়িতে লেগে থাকা লোনা জলের ছাপ, আর বর্ষার দিনে বৃষ্টির সাথে সাগরের তাণ্ডব যেন রূপকথার দৃশ্যের মতো। সাগরবেষ্টিত হলেও চরটি যেন ক্লান্ত জীবনের জন্য একটি শান্তিপূর্ণ আশ্রয়।
যেভাবে পৌঁছানো যাবে সেই ঢাকা থেকে সড়কপথে বা লঞ্চযোগে বরগুনা অথবা আমতলী হয়ে তালতলী উপজেলা সদর, সেখান থেকে নৌকা বা স্থানীয় যানবাহনে সোনাকাটা ইউনিয়নের নিদ্রা সৈকতে যাওয়া যায়। তালতলীতে রয়েছে আবাসিক হোটেল, উপজেলা ডাকবাংলো ও কিছু কটেজ। তবে সৈকতের একেবারে পাশে এখনো পর্যাপ্ত আবাসন ও আধুনিক অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি।
পর্যটকদের অভিজ্ঞতা বেতাগী সরকারি কলেজ এর প্রভাষক সঞ্চিব রায় বলেন, প্রথমে শুনেছিলাম, এখানে যাওয়া ঝামেলার। কিন্তু পৌঁছে যা দেখলাম, তাতে মন ভরে গেছে। প্রকৃতির এত নিবিড় সৌন্দর্য খুব কম জায়গাতেই আছে। সরকার চাইলে এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো পর্যাপ্ত সম্ভাবনা রয়েছে।
পর্যটনের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ তালতলীর ইউএনও উম্মে সালমা বলেন, নিদ্রা সৈকতকে ঘিরে সরকার ইতিমধ্যেই পর্যটন উন্নয়নের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নিরাপত্তা, যোগাযোগ ও পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ চলছে।
পর্যটন উদ্যোক্তা অ্যাডভোকেট সোহেল হাফিজ জানান, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন ‘টেংরাগিরি’, ফাতরার চর, সোনাকাটা ইকোপার্কের মতো নিদ্রা সৈকতও জাতীয় পর্যটন মানচিত্রে যুক্ত হোক—এটাই প্রত্যাশা।
স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক কমিটি সৈকতের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, আগত পর্যটকদের নিরাপত্তা এবং তথ্য সহায়তায় সক্রিয়। তবে শৌচাগার, রেস্ট হাউস, গাইড সেন্টার বা লাইফগার্ড ব্যবস্থা এখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
পর্যটন প্যাকেজ ও ভবিষ্যৎ দিগন্ত নিদ্রা সৈকত,শুভসন্ধ্যা সমুদ্র সৈকত (জোছনা উৎসবের কেন্দ্র), টেংরাগিরি ম্যানগ্রোভ বন, সোনাকাটা ইকোপার্ক, ফাতরার চর এই জায়গাগুলো একত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ “ইকো-ট্যুরিজম প্যাকেজ” হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, স্থানীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধ হবে, আর পরিবেশও রক্ষা পাবে সঠিক পরিকল্পনায়।
নিদ্রা সৈকত কেবল একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি হতে পারে বাংলাদেশের টেকসই পর্যটনের রোল মডেল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, পরিকল্পিত অবকাঠামো, পরিবেশগত ভারসাম্য এবং জনগণের অংশগ্রহণের সমন্বয়ে নিদ্রা সৈকত একদিন দেশের গর্ব হয়ে উঠবে।
নয়াশতাব্দী/এইচ