
ঢাকার অভিজাত বারে এখন প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে অবৈধ ভারতীয় মদ। সীমান্তে বিজিবির নজরদারি, কাস্টমস ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রচার—সবই যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে এই এক ব্যবসার প্রশাসনের একাংশের উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার সুযোগ নিয়ে গড়ে উঠেছে শক্তিশালী মাদক সিন্ডিকেট। প্রতিদিন সীমান্ত পেরিয়ে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় মদ রাজধানীতে ঢুকছে, আর তা বিক্রি হচ্ছে প্রশাসনের চোখের সামনে—নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে।
বারগুলোর অভ্যন্তরে এখন শুধু বসে পান করার ব্যবস্থাই নেই, বরং সরাসরি 'পার্সেল' দেওয়া হচ্ছে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা ক্রেতাকে। যেন মদের কোনো ক্যাশ অন ডেলিভারি সেবা চালু হয়েছে রাজধানীতে। প্রশাসন নিশ্চুপ। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে ম্যানেজ করে দিনের পর দিন চালানো হচ্ছে কোটি কোটি টাকার অবৈধ বাণিজ্য। মদের বোতলে লেখা ভারতীয় মূল্য মাত্র ২৪১ রুপি—বাংলাদেশি টাকায় ৩৪১ টাকা ৭০ পয়সা। অথচ সেই বোতলই রাজধানীর বারে বিক্রি হচ্ছে ২৩০০ থেকে ৪৮০০ টাকায়!
ইস্কাটনের ‘গোল্ডেন ড্রাগন বার’-এ গিয়েই ধরা পড়ে ভয়াবহ এক চিত্র। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ। অথচ ভিতরে তৎপরতা থেমে নেই। ফটকে থাকা কর্মচারী সোজা জানিয়ে দেন, শুধু পার্সেল, ভিতরে বসা যাবে না। মদের খোঁজ করতে গেলে একজন জানায়, বড় ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। কিছুক্ষণ পর উপস্থিত হন সেই ‘বড় ভাই’। বারটির নেপথ্য নিয়ন্ত্রক তিনি। কয়েকটি প্রশ্ন করতেই রীতিমতো বিরক্ত হয়ে বলেন, “রয়েল স্ট্যাগ লাগবে? ৪৮০০ টাকা দেন। না লাগলে যান। কিন্তু দর কষাকষি করলে বলেন, ২৩০০ দিলেই হবে, সামনের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কাছে গিয়ে টাকা দিন, সে আপনার হাতে তুলে দেবে।
যে ব্যক্তি আমাদের হাতে মদের ব্যাগ তুলে দেন, তার নাম আব্দুল্লাহ। এই কাজ যেন তার নিত্যদিনের রুটিন। হাতে তুলে দেন রয়েল স্ট্যাগ—একটি কালো ব্যাগে মোড়ানো অবৈধ ভারতীয় মদ। কালো ব্যাগে মোড়ানো বোতলের গায়ে লেখা ভারতীয় মূল্য ২৪১ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৪১ টাকা। অথচ সেটি বিক্রি হচ্ছে ৬-৭ গুণ বেশি দামে—ট্যাক্স বা শুল্ক ছাড়াই! সরকার যেখান থেকে রাজস্ব নিতে পারতো, সেখানে এখন শুধু পকেটভর্তি করছে একটি চক্র।
এই বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় গোল্ডেন ড্রাগন বারের ম্যানেজার আওলাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দেন।
শুধু গোল্ডেন ড্রাগন নয়, শাহবাগের ‘হোটেল পিকক অ্যান্ড বার’-এ গিয়েও একই চিত্র। নাম না বলা শর্তে এক কর্মচারী জানালেন, ইন্ডিয়ান লাইসেন্স নাই। তারপরও বেচি। ব্লু আছে, ম্যাজিক মোমেন্ট আছে, রয়েল স্ট্যাগ চাইলে আনবো। এখানে ম্যাজিক মোমেন্টের বোতলে লেখা দাম ১৮০ রুপি—বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৫৪.৮৬ টাকা। অথচ আমাদের কাছ থেকে নেওয়া হয় ২৩০০ টাকা।
এভাবে রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত বারে প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে হাজার হাজার বোতল অবৈধ ভারতীয় মদ। যার একটিও বৈধ পথে আমদানি হয়নি। কাস্টমস ডিউটি, ভ্যাট, ট্যাক্স—সব কিছু ফাঁকি দিয়ে এই বাজারে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এবং এসব টাকার কোনোটিই রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা পড়ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই প্রতিদিন প্রায় ৫০ থেকে ১০০ কোটি টাকার অবৈধ মদ বিক্রি হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে একটি সুসংগঠিত সিন্ডিকেট, যারা পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশনের কিছু দুর্নীতিপরায়ণ কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করেই এই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
এই বিষয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সেগুনবাগিচা কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে প্রথমে ‘ব্যস্ততা’ দেখিয়ে পরদিন কথা বলার আশ্বাস দেওয়া হয়। পরদিনও নানা অজুহাতে এড়িয়ে যান আমাদের প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে প্রশাসনের নিরবতা ও দুর্বলতার সুযোগে রাজধানীজুড়ে গড়ে উঠেছে এক ভয়াবহ কালোবাজার। যা কেবল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকেই বিপন্ন করছে না, বরং দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকেও করছে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
নয়াশতাব্দী/এসআর